বয়ঃসন্ধিকালীন মানসিক পরিবর্তন
বয়ঃসন্ধিকাল শব্দটা আমাদের কারো কাছে পরিচিত আবার কারো কাছে অপরিচিত। এই সময়টা প্রতিটা মানুষের জীবনেই আসে।
ঠিক কোন সময়টাকে বয়ঃসন্ধিকাল বলা হয় ? বয়ঃসন্ধিতে ছেলে মেয়েদের সমস্যা
বয়ঃসন্ধিকাল হচ্ছে শৈশব ও যৌবনের মাঝের সময়টা। সাধারণত ১০ থেকে ১৯ বছর সময়টাকে বয়ঃসন্ধিকাল বলা হয়। কিন্তু এসময়সীমা ২৪ বছর পর্যন্ত চলতে পারে।
পৃথিবীর সব দেশের ছেলে মেয়েদের মধ্যে এই সময়টায় শারীরিক এবং মানসিক পরিবর্তন দেখা যায়। এ সময়টা হচ্ছে কৌতুহলের সময়।বয়ঃসন্ধিকালে করণীয় বিষয়গুলো গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে।
বয়ঃসন্ধিকালের মানসিক পরিবর্তন সম্পর্কে
মনরোগবিদ মেখলা সরকার বলেছেন ” এই সময় কাল থেকে ছেলেমেয়েদের মধ্যে আত্মপরিচয়
গড়ে উঠতে শুরু করে। “
ছেলেমেয়েরা এসময়টাতে হঠাৎ করে তাদের চারপাশে একটা দেয়াল
বানাতে শুরু করে। বাবা মার সাথে তাদের
দূরত্ব বাড়তে থাকে। চারপাশের সবকিছুর প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়।
ডা. মেখলা এ ব্যাপারে বিবিসি বাংলাকে বলেন ” শৈশবে বাবা মা যেমন বলত তারা তাই
ভাবত, তাই করতো। কিন্তু এই সময়টা থেকেই তারা স্বাধীনভাবে সবকিছু ভাবতে শুরু করে।
সে কি পরবে, কি খাবে সেটা তারা নিজে থেকেই সিদ্ধান্ত নেয়। যা তাদের পরিবারের থেকে
আলাদা হতে পারে। এজন্য বাবা মায়ের সাথে দূরত্ব তৈরি হতে থাকে। ভাল মন্দের একটা
কনসেপ্ট তৈরি হয়, যদিও সেটাকে
খুব পরিপক্ব বলা যাবে না “।
মুড সুইং:
এই সময়টাতে ছেলেমেয়ে উভয়েরই শারীরিক নানা পরিবর্তন আসে। এসব পরিবর্তনের কারন হচ্ছে
দেহের বিভিন্ন হরমোন। হরমোনাল এই
পরিবর্তনের বাহ্যিক প্রকাশ হচ্ছে মুড সুইং। মন মেজাজ খুব দ্রুত ওঠানামা করাকে বলে
মুড সুইং।
তারা আশপাশের মানুষজন বিশেষ করে বাবা মাকে প্রতিদন্দ্বী ভাবে।এই সময় বন্ধুবান্ধবরা তাদের আপনজন হয় । তারা মনে করে কেউ তাদের বুঝে না। আবেগের প্রাবল্য দেখা যায় এই সময়টাতে।
বয়সন্ধিকালে কিশোর কিশোরীদের আচরন সম্পর্কে জানুন
ডিপ্রেশন বা হতাশা :
মানসিক পরিবর্তনের অন্যতম একটা টানাপোড়ন হচ্ছে ডিপ্রেশন বা হতাশা। কেউ তাদের বোঝে না এই ধারনা থেকেই ছেলেমেয়েরা একা থাকতে শুরু করে। এই একাকীত্বই তাদের মাঝে হতাশার সৃষ্টি করে। পরিবার পরিজন এর সাথে দূরত্ব, নিজের মধ্যকার কলহ নিজের মাঝেই পুষে রাখে। ক্রমাগত সে হতাশার ধূম্রজালে আটকা পড়ে যায়।বয়সন্ধিকালে প্রেম জনিত কারণে অনেক ছেলে মেয়েরা হতাশায় ভুগে থাকে। তাই বয়সন্ধিকালে প্রেম বিষয় অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। ছেলে মেয়েদের সাথে এই সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করা উচিত।
বয়ঃসন্ধিকালিন
ঝুঁকিসমূহ:
আবেগের তাড়নায় চালিত হয়ে ছেলে মেয়েরা ভুল পথে পা বাড়ায়।
⭕ছেলেরা বিশেষ করে সিগারেট অর্থাৎ ধূমপান, মদপান, মাদকদ্রব্য, ইয়াবা এসবের দিকে ঝুকে পড়ে। বাবা মার সাথে কলহ বাড়ায় তারাও অনেক সময় এ বিষয়ে অজ্ঞাত থাকে।
⭕অসৎ সহপাঠীদের সাথে মিশে বেশির ভাগ ছেলেই নেশার জগতে নিজেকে ঠেলে দেয়।বয়ঃসন্ধিকালে করণীয় বিষয় নিয়ে সচেতনতা জরুরী
⭕হরমোনাল পরিবর্তনের কারনে ছেলে মেয়েদের একে অপরের প্রতি আকৃষ্ট হয়। আবেগ তাড়িত হয়ে তারা অনেক ভুল কাজ করে।
⭕অনেকে কৈশোরেই
নানা অপরাধ এর সাথে লিপ্ত হয়। এভাবে দেশের ভবিষ্যৎ
হুমকির সম্মুখীন হয়।
বয়ঃসন্ধিকালে করণীয় – পরিবারের করনীয় :
বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেমেয়েদের সঠিক পথে ধরে রাখতে পরিবারকে কৌশলী ভূমিকা পালন করতে হবে।
ডা.মেখলা সরকার বলেন, ” এই বয়সে ছেলে
মেয়েরা বাবা মার চেয়ে বন্ধুদের কথায় বেশি প্রভাবিত হয়। বাবা মায়ের বাধা মেনে নিতে
না পেরে তাদের বিপক্ষে চলে যায়। বাবা মায়ের পক্ষেও কঠিন হয়ে যায় সামলানো। তবে
ধৈর্য হারালে চলবে না। তাদের আচার আচরনের প্রতি সম্মান দেখাতে হবে।”
বাবা মাকে ছেলেমেয়ের বন্ধু হয়ে উঠতে হবে।
তারা যাতে নির্ভয়ে সব কথা শেয়ার করতে পারে সেই সুযোগ করে দিতে হবে। তারা কোথায়
যাচ্ছে, কি করছে , কার সঙ্গে মিশছে এসব
ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে। বিপথে গেলে ঠাণ্ডা মাথায় বুঝাতে হবে ।
অযথা গায়ে হাত তোলা যাবে না। অন্যথায় তারা বাবা মার প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলবে।
তাদের সাথে সময় কাটাতে হবে এবং তাদের সাথে বন্ধুসুলভ আচরন করতে হবে।
বন্ধু / বান্ধবী নির্বাচনঃ
বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেমেয়েরা কোনটা ভুল বা কোনটা ঠিক সেটা বুঝতে পারে না। তাদের কাছে যেটা ভাল লাগে সেটাই তারা করে। এর ফলে তারা অনেক সময় বিপদের সম্মুখিনও হয়ে থাকে। এ সময় তারা তাদের বন্ধু বান্ধব বা সহপাঠীদের দ্বারা অধিক প্রভাবিত হয়। তাদের বন্ধু বান্ধব বা সহপাঠীরা যদি সৎ,পরিশ্রমী ,সাহসী ও নীতিবান হয় তবে তাদের চরিত্র ও সেভাবে গড়ে উঠবে। অন্যদিকে তাদের বন্ধু বান্ধব বা সহপাঠীরা যদি অসৎ, লম্পট ও নেশাখোর হয় তবে তারাও সেভাবে গড়ে উঠবে।
তাই কবি বলেছেন , “সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস,অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ”
আর তাই বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেমেয়েদের প্রতি বাবা মায়ের অধিক যত্নশীল হতে হবে। তারা কোথায় যায়, কাদের সঙ্গে মেলামশা করে সেগুলো সম্পর্কে ভালভাবে খোঁজ খবর রাখতে হবে। তারা যেন কারো ফাঁদে পা না দেয়। তাদেরকে সঠিক বন্ধু বান্ধব বা সহপাঠী নির্বাচনে সাহায্য করতে হবে। বয়ঃসন্ধিকালে করণীয় বিষয় অনেক কারণ বাবা মা পারে তার সন্তানকে সঠিক পথে আটকে রাখতে,হোক সেটা সঠিক নির্দেশনা দিয়ে বা শাসন করে বা অনুপ্রেরণা দিয়ে বিভিন্ন ভাবেই সন্তানকে বয়ঃসন্ধিকালে সঠিক পথে রাখা সম্ভব।
বয়ঃসন্ধিকালে প্রতিষ্ঠানের যা করনীয় :
♦ছেলেমেয়েদেরকে বয়ঃসন্ধিকালিন সময় সম্পর্কে ধারনা দিতে হবে। পাশাপাশি সেক্স এডুকেশন এর ও ব্যবস্থা রাখতে হবে।
♦বাবা মাকে বন্ধুসুলভ আচরনের ব্যাপারে অবগত করতে হবে।বয়সন্ধিকালে প্রেম ঘটিত কোন বিষয় নিয়ে সন্তানের সাথে সরাসরি স্বাভাবিক ভাবে আলোচনা করতে হবে।।
♦ছেলেমেয়েরা যাতে ভুল পথে না যায় এদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
♦পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের বিনোদনমূলক ও শিখনীয় কার্যক্রম এর ব্যবস্থা রাখতে হবে।
♦টেকনোলজির সদব্যবহার শিখাতে হবে।
বাবা মায়ের বন্ধুত্বপূর্ন মনোভাব আর সকলের সহযোগীতাই পারে ছেলেমেয়েদের বয়ঃসন্ধিকালিন মানসিক জটিলতা কাটিয়ে উঠে হাসিখুশি জীবন দিতে।