কিশোর কিশোরীদের আচরন ও বয়ঃসন্ধিকালে করনীয়
প্রতিটা মানুষকেই জন্মের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত অনেক গুলো ধাপ অতিক্রম করতে হয়। এগুলো হচ্ছে শৈশব, কৈশোর, যৌবন, প্রাপ্ত বয়স, বার্ধক্য। এ ধাপ গুলো অতিক্রম করার সময় মানব জীবনে নানা ধরনের পরিবর্তন আসে। সবচেয়ে পরিবর্তন আসে কিশোর বয়সে। এ সময়টাকে বয়ঃসন্ধি কাল ও বলা হয়। এই সময় এ ছেলেদেরকে কিশোর আর মেয়েদেরকে কিশোরী বলা হয়।
বয়ঃসন্ধিকাল হচ্ছে শৈশব ও যৌবনের মধ্যবর্তী সময়টা। সাধারণত ১০ থেকে ১৯ বছর পপর্যন্ত সময়কে বয়ঃসন্ধিকাল বলা হয়। কিন্তু এসময়সীমা ২৪ বছর পর্যন্ত চলতে পারে।
পৃথিবীর সব দেশের ছেলে মেয়েদের মধ্যে এই সময়টায় শারীরিক এবং মানসিক পরিবর্তন দেখা যায়। তবে বর্তমানে ভৌগোলিক পরিবেশ, আবহাওয়া, আর খাদ্যাভাসের তারতম্য অনুযায়ী এই সময় সীমা পরিবর্তন হচ্ছে।
বয়ঃসন্ধিকালে মানসিক নানা চেঞ্জ আসে সেই সাথে সাথে আচরনেও পার্থক্য দেখা দেয়। কিশোর কিশোরীদের আচরনের এই দিক গুলো ইতিবাচক আবার নেতিবাচক ও হতে পারে। এই ব্যাপারে আগে থেকেই খেয়াল রাখতে হবে। তাহলে সমস্যা গুলো এড়ানো যাবে।
আত্মনির্ভরতা :
কিশোর কিশোরীরা এসময় স্বাধীনচেতা মনোভাব
পোষন করে। তাদের আচর
আচরনে আত্মনির্ভরতা দেখা যায়। সব
বিষয়ে নিজের মতামত পোষন করে। নিজেকে
পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ভাবতে শুরু করে। সামান্য
কথাতেও তাদের আত্মসম্মান বোধ বাধা পায়।
মনোরোগবিদ ডা. মেখলা এ ব্যাপারে বিবিসি বাংলাকে এক আলোচনায় বলেন “শিশুকালে ছেলেমেয়েরা বাবা মাকে অনুসরণ করে। কিন্তু এই বয়সটাতে তারা নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পছন্দ করে যেমন কি পরবে, কি খাবে তা তারা নিজেরা সিদ্ধান্ত নেয়। যা তাদের পরিবারের থেকে আলাদা হতে পারে। এজন্য বাবা মায়ের সাথে দূরত্ব তৈরি হতে থাকে। ভাল মন্দের একটা কনসেপ্ট তৈরি হয়, যদিও সেটাকে খুব পরিপক্ব বলা যাবে না “।
পাঠকের মনে হতে পারে, এইটুক ছেলে মেয়ের কি সম্মান বোধ, আর কি বা মতামত। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে এসময় থেকেই তাদের মতের গুরুত্ব দিতে হবে।
আত্মসচেতনতা::
আত্মসচেতন হওয়ায় তখন হঠাত করেই নিজের পোশাক, সাজ গোজের প্রতি সজাগ হয়।
নিজেকে পরিপাটি রাখার চেষ্টা করে। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে ফ্যাশন উপযোগী কাপড় পড়ে।
খাবারের প্রতি অনীহা দেখায়। বাসার তৈরি খাবারের থেকে বাইরে তৈরি খাবার বেশি পছন্দ করে।
কিশোরীরা নিজের ওজন নিয়ন্ত্রনে রাখতে চায়।
বন্ধুবান্ধব ::
ছেলে মেয়েরা এসময় নতুন নতুন
মানুষের সাথে মিশতে শিখে।
বন্ধু বান্ধব বানায় অনেক।
তাদের সময় কাটাতে পছন্দ
করে। আর পরিবারের সাথে
হঠাত করেই দূরত্ব বেড়ে
যায়। তারা ভাবে বাবা
মা তাকে বুঝতে চায়
না। তাকে গুরুত্ব দেয়
না। পরিবার অপেক্ষা বন্ধুদের সাহচর্যই তখন তারা বেশি
পছন্দ করে।
আবেগপ্রবণ :
এই বয়সে হরমোনাল চেঞ্জ আসে। যার জন্য তাদের স্নেহ ভালোবাসা এই আবেগ গুলো তীব্র হয়ে পড়ে। তারা সবকিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকে।
কেউ তাদের বুঝে না এই ধারনা থেকেই তারা নিজেদের একটা জগত গড়ে নেয়।
আবেগের বশত অনেক সময় তারা ভুল পথে পা বাড়ায়। অনেক সময় ভুল সিদ্ধান্ত নেয়।
বয়ঃসন্ধি কালিন পরিবর্তনের জন্য কিছু মানসিক সমস্যাও দেখা দেয়।
কিশোর কিশোরীদের মানসিক সমস্যা ও তার সমাধান :
রাগ :
ব্যক্তিগত মনোভাব প্রকাশের অন্যতম একটা উপাদান রাগ। সাধারণত আশাহত হলে, কোনো কাজ সঠিকভাবে করতে না পারলে, কারো কোনো কথায় অপমানিত হলে, রাগের প্রকাশ ঘটে। রাগের বশে মানুষ মারামারি হত্যা খুন প্রভৃতি জঘন্য কাজের সাথে লিপ্ত হতে পারে। রাগের জন্য অন্যের সাথে সম্পর্ক নষ্ট হয়। রাগ নিয়ন্ত্রনে রাখার দিকে নজর দিতে হবে।
রাগ কমাতে হলে যা যা করতে হবে :
# রাগের সময় তাৎক্ষনিক কোন সিদ্ধান্ত না নেয়াই ভালো। আগে রাগ কমার সুযোগ দিতে হবে তারপর বিষয়টি ভালোভাবে বুঝতে হবে।
# গাঢ় শ্বাস নিলে রাগ কমানোর
ক্ষেত্রে উপকার পাওয়া যায়।
# সুন্দর সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য
রাগ পুষে না রেখে
বিবাদ মিটিয়ে ফেলাই শ্রেয়। দরকার বোধে যেকোন সমস্যা
নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করতে হবে।
মনোভাবের প্রাধান্য না পাওয়া :
এসময় থেকেই ছেলে মেয়েরা নিজেদের
মতামত তুলে ধরার চেষ্টা
করে। তাদের মতের প্রাধান্য দেয়া
না হলে তারা ক্ষিপ্ত
হয়। তারা অন্যায় সহ্য
করতে পারে না। কোনো
কারনে প্রত্যাখাত হলে তারা মানসিক
ভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে।
এই অবস্থায় – তাদেরকে ভালো মন্দ সম্পর্কে
সঠিক ধারনা দিতে হবে। কোনটা
উচিত, কোনটা অনুচিত এ বিষয়গুলোও মাথায়
রাখতে হবে। যেকোন বিষয়কেই
যুক্তি দিয়ে বুঝতে হবে।
মূল্যবোধের অবক্ষয় হয় এমন কোনো
কাজ করা যাবে না
– এব্যাপারে ওদেরকে সঠিক ধারনা দিতে
হবে।
ব্যঙ্গ ::
অনেক সময় বন্ধুবান্ধবরা মিলে
ইচ্ছাকৃত ভাবে বিদ্রূপ করে
থাকে। অপরকে ছোট করে কথা
বলে। ব্যঙ্গ করে। অনেক ছেলে
মেয়েই হাসি ঠাট্টা নিতে
পারে না। তারা হীন
মন্যতায় ভোগে। অনেকে আত্মহত্যার পথ ও বেছে
নেয়। তাই এই ধরনের
কর্ম কান্ড থেকে বিরত থাকতে
হবে।
ঠাট্টাকে সিরিয়াসলি নেয়া যাবে না।
দরকারে খোলাখুলি আলাপ করতে হবে।
ব্যর্থতা ::
যেকোন কাজ করতে গেলে
ব্যর্থতা আসবে এটাই নরমাল।
ব্যর্থতায় হতাশ হয়ে না
পড়ে প্রবল উদ্যমে এগিয়ে যেতে হবে। ” failure is the pillar of success
” এই কথাটা মাথায় রাখতে হবে। সফলতা ও
ব্যর্থতাকে জীবনের অংশ হিসেবে মেনে
নিতে হবে। বাস্তবতা ভিত্তিক
লক্ষ ধরে নিয়ে সামনে
আগাতে হবে।
বাবা মায়েরা পরীক্ষায় ফেল করলে অনেক সময় বকা দেয়। অভিভাবকদেরকে এই ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। তাদের বকা যেন নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে। তাদের ব্যর্থতার কারন খুজে বের করে তারা যাতে সফল হতে পারে এই জন্য তাদেরকে সহযোগীতা করতে হবে।
পরিবারের সাথে কলহ ::
এই বয়সে বাবা মার
সাথে বিভিন্ন বিষয়ে মতভেদ দেখা দেয়। দেখা
গেছে ব্যাপক স্বাধীনতা, ধর্ম পালনে অনীহা,
পছন্দ অপছন্দ, আধুনিক ফ্যাশন, সোশ্যাল মিডিয়ার কুপ্রভাব ইত্যাদি কলহের মূল কারন। অভিভাবকদের
ছেলে মেয়েদের অবস্থা বুঝতে হবে এবং সাথে
সাথে তাদের প্রতি বন্ধুসুলভ আচরন করতে হবে।
তাদেরকে বুঝাতে হবে ” বাবা মা কখনো
সন্তানের খারাপ চান না”।
যেকোন ব্যাপারে তাদের সাথে সরাসরি কথা
বলতে হবে।
পারিবারিক কলহ ছেলে মেয়েদের মানসিক বিকাশকে ব্যাহত করে।এক গবেষনায় দেখা গেছে, ডিভোর্স ফ্যামিলিদের ছেলে মেয়েদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। বাবা মায়ের মধ্যে সুসম্পর্ক না থাকলে ছেলে মেয়েরাও চিন্তিত থাকে। হতাশায় ভোগে। সন্তানের সামনে উচ্চ আওয়াজ এ কথা বলা, কটু বাক্য ব্যবহার, গাল মন্দ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
ছেলে মেয়েরা কোথায় কি করছে, কার সাথে মিশছে এ বিষয়ে খেয়াল রাখা দরকার।
আপনাদের হ্য়ত বাবা মাকে হত্যাকারী ঐশির কথা মনে আছে। ঐশির এমনটা হওয়ার মূল কারন ছিল বন্ধু বান্ধব আর বাবা মায়ের অসচেতনতা। এরকম অবস্থাকে এড়ানোর জন্য সন্তানের প্রতি খেয়াল রাখাটা একান্ত দরকার।
মানসিক চাপ বা ডিপ্রেশন :
বয়ঃসন্ধিকালে অনেক দৈহিক পরিবর্তন
আসে। সেই সাথে মান্সিক
পরিবর্তন আসে। তারা এই
চেঞ্জ এর সাথে খাপ
খাওয়াতে পারে না, তাই
হতাশায় ভোগে। সহ্য করার ক্ষমতা
হারিয়ে গেলে হতাশা, দুশ্চিন্তা
আরো বেড়ে যায়। এই
অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য
তারা যাতে সর্বদা প্রাণোচ্ছল
থাকে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।
তাদের জন্য খেলাধুলার পাশাপাশি
সুস্থ বিনোদন এর ব্যবস্থা করতে
হবে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাব যেন না পড়ে
সেদিকে ও খেয়াল রাখতে
হবে। সব কিছুতে পজিটিভ
থাকতে হবে।
অজানাকে জানার কৌতূহল::
বয়ঃসন্ধি কালে ছেলে মেয়েদের
মধ্যে নানা পরিবর্তন আসে।
এ সময় অজানাকে জানার
কৌতূহল বাড়ে। এর জন্য তারা
হঠাত করে বন্ধুবান্ধব এর
পাল্লায় পড়ে সিগারেট, মদ,
গাজা এসব খেয়ে থাকে।
যা পরবর্তীতে তাদের নেশার কারন হয়ে দাঁড়ায়।
আর এই নেশার টাকা
জোগাড় করতে গিয়ে পরিবারের
সাথে ঝগড়ার সূত্রপাত ঘটায়।এতে পরিবারেও অশান্তির সৃষ্টি হয়। টাকার যোগান না হলে তারা
চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, খুন খারাবি প্রভৃতি
ঘৃন্য কাজে লিপ্ত হয়।
যা দেশ ও জাতির
জন্য ক্ষতিকর।
হরমোনাল পরিবর্তনের কারনে ছেলে মেয়েদের একে
অপরের প্রতি আকর্ষনের সৃষ্টি হয়। তারা যেন
কোন ভুল পথে পা
না বাড়ায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তাদের অজান্তেই
তাদের গতিবিধির দিকে খেয়াল রাখতে
হবে।
বাবা মাকে হতে হবে বেস্ট ফ্রেন্ড এর মত। তারা যাতে নির্ভীঘ্নে সব কথা বলতে তাদের জন্য সেই ব্যবস্থা করব দিতে হবে। এছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও টীচারদেরকে আলাদা ভাবে নজর রাখতে হবে। তাদের মানসিকভাবে বেড়ে ওঠার সুষ্ঠু পরিবেশ আমাদেরকেই দিতে হবে।
কাজেই পাঠকদের প্রতি অনুরোধ তারা যাতে ছেলে মেয়েদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখে। বিপথে না যায়। বয়ঃসন্ধিকালিন সমস্যা গুলোকে বুদ্ধি সহকারে পরিচালনা করতে হবে। কারন আজকের এরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। ওদের মানসিক চাপ থেকে মুক্তিই ওদের সুষ্ঠু বিকাশ এর সু্যোগ করে দিবে।এবং ভবিষ্যৎ উজ্জল হবে।
বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নিয়ে প্রতিবেদনটি লিখেছেন – ” নওশিন মারজিয়া, মেডিকেল শিক্ষার্থী ”