হৃদরোগ থেকে মুক্তির উপায়

হৃদরোগ থেকে মুক্তির উপায় কি

বর্তমান বিশ্বের অন্যতম নীরব ঘাতক ব্যাধি হল হৃদরোগ বা হার্ট এ্যাটাক। পূর্বে শুধুমাত্র উচ্চবিত্ত
দেশে এই রোগের প্রাদুর্ভাব ছিল। কিন্তু বর্তমানে বিশ্বের সকল দেশে এই রোগে আক্রান্ত রোগির সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আমাদের বাংলাদেশ ও এই ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। এই রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা না নেয়া হলে অচিরেই এই রোগে আক্রান্ত রোগির মৃত্যুর সংখ্যা কল্পনাতীত হয়ে দাঁড়াবে।  বর্তমান বিশ্বে প্রায় ৪৫ ভাগ রোগির মৃত্যুর প্রধান কারন হৃদরোগ।

হৃদরোগ কী???

দেহের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ন অংশ হচ্ছে হৃদযন্ত্র বা হৃদপিন্ড।এর মূল কাজ হচ্ছে রক্ত পরিশোধন করা। এটি প্রতিনিয়ত রক্ত পাম্পের মাধ্যমে নিয়মিত দেহের বিভিন্ন স্থানে রক্ত পরিবহন করে দেহকে সচল রাখে। এখানে এসে দূষিত রক্ত জমা হয় আর বিশুদ্ধ রক্ত দেহের বিভিন্ন স্থানে পরিবহন করে। দেহে রক্ত পরিবহনের কাজ করে ধমনী আর শিরা। আর হৃদযন্ত্রের ধমনীকে বলা হয় করোনারি ধমনী। এই ধমনীতে কোনো কারনে ব্লকেজ হলে হৃৎপিন্ডে রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়াকে বলা হয় হার্ট এ্যাটাক বা হৃদরোগ।

কার্ডিয়াক এরেস্ট আর হার্ট এ্যাটাক কি এক???

কার্ডিয়াক এরেস্ট আর হার্ট এ্যাটাক কখনোই এক না। হঠাত হার্টবিট বন্ধ হয়ে গেলে কার্ডিয়াক এরেস্ট হয়। হার্টে কোনো সমস্যা দেখা দিলে এমন অবস্থা হয়ে থাকে। এতে করে হার্টবিট অনিয়মিত হয়ে যায়। এই দুটি রোগের প্রাথমিক পার্থক্য হল হার্ট এ্যাটাকে রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয় কিন্তু হার্টবিট থামেনা।

হার্টবিট কেন বাড়ে??

  • হার্টের ভালভের রোগ, জন্মগত সমস্যা, এনুমালি থাকলে হৃদ স্পন্দন বেশি হয়
  • শারীরিক পরিশ্রম, ব্যায়াম, জগিং বেশি করলেও বীট বেড়ে যায়।এজন্য খেলোয়াড়দের হার্টবিট অন্যান্য দের তুলনায় বেশি।
  • রক্তে শর্করা কমে রোগি হাইপোগ্লাইসেমিক হয়ে যায়। এই অবস্থায় ঘাম বের হয় বেশি বেশি তখন বুক ধড়ফড় করে। মূলত হার্টবিট বাড়ে।
  • নিকোটিন অর্থাৎ বেশি ধূমপান করলে বিট বাড়ে।এছাড়া  অন্যান্য ড্রাগ, মরফিন, ইয়াবা, ফেন্সিডিল এসব ও হৃদ স্পন্দন বৃদ্ধির কারন।
  • চা কফি এগুলা অধিক খেলেও হার্টবিট বেড়ে যায় বলে গবেষনায় প্রমানিত। কারন এসবে ক্যাফেইন থাকে যা হৃদ স্পন্দন বাড়ায়।
  • সালবিউটামল, এম্লোডিপিন ইত্যাদি ওষুধ গুলো হার্টবিট বাড়িয়ে দেয়।
  • হাইপোথার্মিয়া,  শ্বাস কষ্ট হলেও হার্টবিট বেড়ে যায়।

হার্ট এ্যাটাকের কারন :

  • মার্কিন ডা.ক্রিচটন দীর্ঘ গবেষনার বলেন ” হৃদরোগের অন্যতম কারন হচ্ছে মানসিক। ” বর্তমানে মানুষ প্রতিনিয়ত কর্মব্যস্ত জীবন কাটাচ্ছে। এ জীবনে রয়েছে হতাশা,  টেনশন , কাজের চাপ,  কোলাহল।  পারিবারিক কলহ, ব্যস্ততা, নিদ্রাজনিত সমস্যা এসব ও কারন। ক্রমাগত এই স্ট্রেস নিয়ে থাকার কারনে তা প্রভাব ফেলে শরীরে রক্ত সঞ্চালন ব্যবস্থার উপর। আর এই স্ট্রেসের কারনে হরমোনের প্রভাব বেড়ে যায়, ফলে পেশি সংকোচন বাধাগ্রস্ত হয়। আর ফলশ্রুতিতে হৃদরোগের সম্ভাবনা দেখা দেয়।
  • টেকনলোজির প্রভাব অথবা কুফল হিসেবে শারীরিক ব্যায়াম সহ অনেক কার্যক্রমের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। মানুষ মাঠে খেলা বাদ দিয়ে রুমে মোবাইল চালাতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। ফলে দেহে চর্বিস্তর পুরু হচ্ছে।  আর চর্বি দেহে জমা হ্য়ে রক্ত পরিবহনে বাধা দিচ্ছে।
  • উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন ও  হার্ট এ্যাটাকের কারন। হাই ব্লাড প্রেসারের রোগিরা এই রোগের বিশেষ ঝুকিতে রয়েছে।
  • ধূমপান যেকোন রোগেরই অন্যতম কারন।ধূমপান করলে ধমনীতে চাপ পড়ে। যারা বেশি ধূমপান করে তাদের হঠাত হার্ট এ্যাটাক হয়ে মৃত্যুর সম্ভাবনা আছে।
  • মহিলাদের চেয়ে পুরুষদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা বেশি
  • রক্তে কোলেস্টেরল এর মাত্রা বেড়ে গেলে এই রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
  • ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগিদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুকি বেশি।
  • পারিবারিক ইতিহাস থাকলে এ রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
  • জেনেটিকাল ফ্যাক্টর ও রোগের জন্য দায়ী হতে পারে।
  • তবে এসব কারনের মধ্যে অত্যাধিক গুরুত্বপূর্ন হিসেবে যে কারনটিকে দায়ী করা হয় তা হল স্ট্রেস। এর জন্য স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকিও বেড়ে যায়।

হৃদরোগের লক্ষন সমূহ

  • বুকে ব্যথা এই রোগের অন্যতম প্রধান কারন। বাহু,  চোয়ালের পিছে ব্যথা, চিন চিনে ব্যথা।
  • বুকে জালাপোড়া করলে সতর্ক হতে হবে কারন এতে রোগের ঝুকি  রয়েছে।
  • বমিবমি ভাব,  বদ হজম দেখা দেয়।
  • ঘনঘন শ্বাস ওঠানামা করে।
  • রোগি ঘামতে থাকে।
  • অনেক সময় প্রচণ্ড শীত অনুভব করে।
  • রোগি অসস্তি অনুভব করে।
  • কার্ডিয়াক এরেস্ট এর লক্ষন ::
  • প্রথমেই মানুষ অজ্ঞান হয়ে যায়
  • শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়।
  • নাড়ীর স্পন্দন পাওয়া যায় না
  • এমনকি কয়েক মিনিটে রোগির মৃত্যু হতে পারে।

হৃদরোগের প্রাথমিক চিকিৎসা :হৃদরোগ থেকে মুক্তির উপায়

সময় মত হাসপাতালে না নেয়া গেলে রোগির মৃত্যু হতে পারে। তবে বেশকিছু পদক্ষেপ নিলে মৃত্যুর ঝুকি এড়ানো সম্ভব।

  • সি পি আর দিতে হবে।
  • আক্রান্ত ব্যক্তিকে খোলামেলা জায়গায় নিতে হবে।
  • আগুনের আশেপাশে থাকলে সেখান থেকে
  • সরিয়ে নিতে হবে।
  • জামাকাপড় হাল্কা করে দিতে হবে যাতে নিঃশ্বাস নিতে সুবিধা হয়।
  • পালস রেট ঘনঘন চেক করতে হবে।
  • বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
  • সি পি আর দেয়া শুরু করতে হবে। এজন্য বুকের মাঝখানে জোরে জোরে চাপ দিতে হবে। শ্বাস নালী খোলা রাখতে হবে।
  • মুখে মুখ লাগিয়ে ১ সেকেন্ড এ দুবার শ্বাস নিতে হবে। এরকম দুমিনিট করতে হবে। এরপর নাড়ীর স্পন্দন চেক করতে হবে। অবস্থার উন্নতি নাহলে হাস পাতালে নিতে হবে। দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
  • রোগিকে ওমিপ্রাজল আর এস্প্রিরিন জাতীয় ওষুধ  খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে ।

হৃদরোগের ঝুঁকি এড়াতে করনীয়:

  • সর্বোপরি টেনশন মুক্ত জীবন যাপনের অভ্যাস করতে হবে। কোনো প্রকার স্ট্রেস নেয়া যাবেনা।
  • খাদ্যাভাস চেঞ্জ করতে হবে। শাক সবজি, ফল মূল বেশি করে খেতে হবে।
  • কোলেস্টেরল মুক্ত খাবার খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে।
  • দৈহিক ব্যায়া্ম করতে হবে। গবেষনায় দেখা গেছে, শারীরিক কসরত হৃদ রোগের ঝুকি কমায়।
  • অন্তত ৩০ মিনিট হাটার অভ্যাস করতে হবে।
  • ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে রাখতে হবে।
  • ধূমপান থেকে বিরত থাকতে হবে। একে পরিহার করতে হবে।
  • মাঝেমাঝে ডাক্তার এর পরামর্শ নিতে হবে।
  • রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখার দিকে খেয়াল রাখতে হবে।

খাদ্য তালিকা:

  • লাল আটা, লাল চিনি, বাদামি পাউরুটি বেশি খেতে হবে। সাদা চিনি, আটা বাদ দিতে হবে।
  • ফল মূল বেশি খেতে হবে বিশেষ করে আধা কাচা সব্জি খেতে হবে।
  • কম চর্বিযুক্ত আমিষ বেশি খেতে হবে। সেদ্ধ ডিম, সয়াবিন খাবার,  মাছ এসব খেতে হবে।
  • লবন খাওয়া কমাতে হবে। বিশেষ করে যাদের উচ্চ রক্তচাপ আছে।
  • খাবার গ্রহণ এর ব্যাপারে নিয়ম কানুন মেনে চলতে হবে। অনিয়ম করা যাবে না।
  • ডাক্তারের নির্দেশ মেনে চলতে হবে। ঔষধ ঠিকভাবে গ্রহণ করতে হবে।

অস্ত্রপাচারের ঝুঁকি :

হৃদরোগিদের অস্ত্রপাচারের সময় সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। রক্তচাপ পরীক্ষা করে নিতে হবে। হৃদ স্পন্দন দেখে নিতে হবে ঠিক আছে কিনা। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

ওপেন হার্ট সার্জারি :

ডাক্তারের চিকিৎসা যদি ফলপ্রসূ না হয় তবে ব্লকেজ দূর করার জন্য ওপেন হার্ট সার্জারি করতে হবে। বাংলাদেশে ও সীমিত পরিসরে এই পদ্ধতি চালু হয়েছে। নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য এই পদ্ধতি খুবই ব্যয় বহুল।

জাতীয় হৃদ্ রোগ ইনস্টিটিউট, জাতীয় হার্ট ফাউন্ডেশন এসব জায়গায় হৃদ রোগ নিয়ে গবেষনা করা হ্য়। এবং একই সাথে এব্যাপারে চিকিৎসা প্রদান করা হয়। বর্তমানে অন্যান্য অনেক জায়গায় এই রোগের চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হচ্ছে।

হঠাত করেই রোগি মৃত্যু বরন করে বলে হৃদ রোগ নীরব ঘাতক হিসেবে পরিচিত। কিছু স্বাস্থ্য বিধি মেনে চললে, টেনশন মুক্ত যাপন করলে এই রোগের ঝুকি এড়ানো যায়। যেহেতু চিকিৎসা পদ্ধতি অত্যন্ত ব্যয় বহুল আমাদের দেশের সাপেক্ষে সুতরাং নিয়ম নীতি মেনে সুস্থ জীবনের দিকে নজর দিতে হবে। সুস্থতা সবার কাম্য।

বাঁচতে হলে জানতে হবে

1 COMMENT

Comments are closed.